শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

নিরাপদে বিনিময় হচ্ছে মাদক-অস্ত্র-পর্ণোগ্রাফি ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ ‘ডার্ক ওয়েব’

মো: শাহাব উদ্দিন
বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত ও বহুমাত্রিক প্রযুক্তির নাম বোধ হয় ইন্টারনেট। এর কল্যাণে সারা পৃথিবী এখন চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে একটি মাত্র ক্লিকে চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে বিশ্বের তাবৎ খবরাখবর।
কিন্তু বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদকেও অপব্যবহার করতে ছাড়েনি অপরাধী চক্র। তাই জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যাবহৃত নিয়মিত ইন্টারনেট সার্চারদের বাইরেও গড়ে উঠেছে একটি গোপন অনলাইন জগৎ। যাকে প্রযুক্তিবিদরা নাম দিয়েছেন ‘ডার্ক ওয়েব ওয়ার্ল্ড’ বা অন্ধকার ওয়েব জগৎ। এ জগৎকে আরও কিছু নামে যাকা হয়, যেমন ডিপ ওয়েব, ডিপ নেট, দি ইনভিজিবল ওয়েব প্রভৃতি।
সমআনজনক কোনো অভিধায় সনাক্তকরণের অযোগ্য এই ভার্চুয়াল জগৎ মূলত এখন ব্যবহার করছে গোপন রাজনৈতিক দলের কর্মীরাসহ বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীও। তারা গোপন ভার্চুয়াল কালোবাজারে নির্বিঘ্নে বিক্রি করছে অস্ত্র, মাদক, নকল পাসপোর্ট ও শিশু পর্নোগ্রাফির মত জঘন্য পণ্য। যা ইন্টারনেটের কল্যানে নিমিসেই পৌঁছে যাচ্ছে যুবকদের কাছে। ফলে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতা।
প্রশ্ন হচ্ছে ওই অপরাধী শ্রেণী কিভাবে এর ফায়দা লুটছে? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ভার্চুয়াল বাজারে যে কেউ একই সময়ে একাধিক ডিলারের সাথে সহজেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। এবং কাস্টমারও পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে পছন্দসই পণ্যের দামদস্তুর করতে পারে।
ডেভিড নামধারী মাদকাসক্ত এক আমেরিকান ছাত্র এ জগতে নিজের প্রবেশের ইতিহাস ও সুবিধা সম্পর্কে কিছুদিন আগে কথা বলেছিলেন মিডিয়ার সামনে। ‘নামধারী’ বলার কারণ হলো এই যে, এ জগতের অধিকাংশ মানুষই নিজের প্রকৃত নাম-পরিচয় গোপন করে চলে।
ডেভিড কেন রেগুলার বাজার থেকে মাদক না কিনে এই অবৈধ অন্ধকার ওয়েব জগৎকে বেছে নিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, রেগুলার বাজারে ড্রাগ কিনতে গেলে পুলিশসহ অনেক ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ডার্ক ওয়েবে সেসবের ভয় নেই। কারণ পুলিশের পক্ষেও এই জগৎ সনাক্ত করা বেশ কঠিনই।
এছাড়া এ বাজার বিশ্ব নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকায় পৃথিবীর যে কোনও স্থান থেকেই এর মাধ্যমে মাদক ছাড়াও অস্ত্র এবং পর্নোগ্রাফির মত জিনিষ সহজেই কেনা-বেচা করা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ভার্চুয়াল বন্য জগতের আরেক বাসিন্দা বলেন, সে মূলত এই জগতে এসেছে নিরাপত্তাবোধ থেকেই। পেশায় সে মাদক বিক্রেতা। সে বলে, মাদকের নিরাপদ লেনদেনের স্বার্থে আমি ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করি।
আরেকজন বলে, আপনি যদি যুবক হন বা খোলাবাজারে গাঁজা কিংবা তার চেয়ে কড়া কোনো মাদকের সন্ধান করেন, তাহলে ঝুঁকি ছাড়া তা জোগাড় করা খুব কঠিন। অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে আপনি গ্রেফতারও হতে পারেন। তাই ওযেবই নিরাপদ। এখনও কোনো দেশে এত কোর্ট, জজ বা পুলিশ নেই যে এই ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
এ ব্যাপ্যারে আমেরিকার ইন্টারনেট সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার জন কার বলেন, বিভিন্ন ডাউনলোড বান্ধব সফটওয়্যার এখন হাতের নাগালে থাকায় ডার্ক ওয়েভের ব্যবহারকারীরা এর ফায়দা লুটছে। তারা একই ক্যাটাগরির দ্বিপক্ষীয় ফাইল শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে একে অন্যের কাছে সহজেই গোপন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। যা অন্যদের কাছে সহজে ধরা পড়ছে না।
জন কার আরো বলেন, এটি শুধুমাত্র ক্রিমিনাল ডোমেইন তাই নয়, এই অন্ধকার জগৎ প্রমাণ করেছে এটি ব্যবহার করে অনেকে রাজনৈতিকভাবেও ফায়দা লুটতে পারে। সপম্প্রতিক বিশ্ব তোলপাড় করা আরব বসন্তে অনেক গোপন সংগঠন এই জগৎ ব্যবহার করে ফায়দা লুটেছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্যও আছে। 
পশ্চিমা দেশগুলোতে পুলিশ এই অন্ধকার জগৎকে সাধ্যমত নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। কোনো কোনো অপরাধী ধরাও পড়ছে। ওইসব অপরাধের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপে যাবৎজীবন কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।
তবে, স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনো এই অপরাধের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পশ্চাৎপদতা, অজ্ঞতা ও জনবল সংকটের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে অনেক অপরাধী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কিছু বিপথগামী অফিসার ইন্টারনেট ব্যবহার করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু সেনা গোয়েন্দাদের সতক্য তৎপরতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরকম জঙ্গিগোষ্ঠীও নানা সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।
তাই বাংলাদেশের মত দেশে সাইবার ক্রাইমের ওই অন্ধকার জগৎ নিয়ন্ত্রণে দরকার সঠিক আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন। অবশ্য ২০০৬ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনটি বিদ্যমান থাকলেও তা সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন বিষয়ে অনেক দেশে ইউজাররা তাদের প্রাইভেসি ভঙ্গ হবে মনে করে আন্দোলনও করছেন। এটি যে খুব বেশি মিথ্যা তাও নয়। অনেক দেশেই ডার্ক ওয়েব নিয়ন্ত্রণের নামে সাধারণ অনেক সাইটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অহেতুক নজরদারির বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
ডার্ক ওয়েবের থাবার বিস্তার থেকে খুবই স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। তাই ক্রমবর্ধমান এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যায় কিনা সরকারসহ সবগুলো মহলকে ভেবে দেখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন