শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১১

জলবায়ু সম্মেলনে ডারবানে অন্যরকম বিক্ষোভ

শাহাব উদ্দীন
জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ছাড় করার দাবিতে মিছিলে মিছিলে বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হলো ডারবান। ডারবানসহ বিশ্বের ১৯৪টি দেশের বিপুল সংখ্যক পরিবেশবাদী অংশ নেন এ বিক্ষোভ মিছিলে। এজন্য গতকাল সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে জড়ো হয় জলবায়ু সম্মেলন কেন্দ্রের চারপাশে। মূলত প্রতি বছর অনুষ্ঠিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের জন্য প্রদত্ত অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গড়িমসি দীর্ঘসূত্রতা নিরসনে এ বিক্ষোভ হয়। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে তাৎক্ষণিক বা জরুরি ক্ষতি মেটাতে ২০১৩ সাল থেকেই অর্থায়নসহ ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে পরিবেশ সচিব মেসবাহ-উল আলম এ প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, অতিঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য জরুরিভাবে অভিযোজন (এডাপটেশন) ও প্রশমনে (মিটিগেশন) সহায়তা প্রয়োজন। 
৭ দফা প্রস্তাবে তিনি বলেন, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) বা জলবায়ু তহবিল অবশ্যই কোপ-এর অধীনে পরিচালিত করতে হবে। যে তহবিল হবে তার অর্থ একটি নিয়মের মধ্যে দেশগুলোকে দিতে হবে। এর একটা আইনগত দিক থাকতে হবে। অর্থ ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি বছর জলবায়ু তহবিলে কোন দেশে কত টাকা দিচ্ছে তা একটি স্বচ্ছ নিয়মের মধ্যে দিতে হবে। অন্য কোন খাতের অর্থকে এ খাতের সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাৎক্ষণিক বা জরুরি অর্থায়ন ২০১৩ সাল থেকেই শুরু করতে হবে। ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর এ খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দিতে হবে। সব থেকে বেশি সমস্যায় থাকা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অর্থায়নের ৫০ শতাংশ এডাপটেশন কার্যক্রমে এবং বাকিটা মিটিগেশনের জন্য খরচ করার সুযোগ দিতে হবে। কানকুনের আলোচনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে হবে। এলডিসি, এসআইডিএস এবং আফ্রিকাকে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য এ তহবিলে টাকা দিতে হবে। সাধারণ তহবিলের বাইরে এ অর্থ দিতে হবে। যা দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
ডারবানে জলবায়ু আলোচনা যতই গতি পাচ্ছে, ততই পরিবেশবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠছেন। এ সম্মেলন থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হোক যেন পরিবেশে আর কোন কালি না পড়ে। যেন মানুষ আর তার ভিটাছাড়া না হয়। যেন সকল জীবাশ্ম বংশানুক্রমে টিকে থাকতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন পরিবেশ সংগঠন বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বিভিন্ন দাবি নিয়েই গতকাল দিনভর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পরিবেশবাদী ডারবানের রাস্তায় জলবায়ু সুবিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একেকজন একেক সাজে সেজে, প্ল্যাকার্ড হাতে, ব্যানার হাতে, গান গেয়ে এই প্রতিবাদ করেন।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের স্থান আইসিসি কমপ্লেক্সের পাশে স্পিকার কর্নারে সমবেত হন বিক্ষোভকারীরা। এখানে সমাবেশ করে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসিসির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারির কাছে স্মারকলিপি পেশ করে। পরে মিছিল নিয়ে নর্থ বিচে গিয়ে শেষ হয়।
ক্লাইমেট জাস্টিস নেটওয়ার্ক এ বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। প্রায় ১০ হাজার পরিবেশবাদী নানা রঙের পোাশাক পরে বাহারি ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সকালে রাস্তায় নামেন। সকাল সাড়ে ৯টায় শহরের বোডা পার্ক থেকে এ মিছিল শুরু হয়। নানা রাস্তা ঘুরে আইসিসি কমপ্লেক্সের পাশ দিয়ে দুপুরে তারা স্পিকার কর্নারে এসে সমবেত হন। সমাবেশে ক্লাইমেট জাস্টিস নেটওয়ার্কের নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন।  এ সময় তারা চলমান জলবায়ু আলোচনায় দরিদ্রদের প্রতি সুবিচার দাবি করেন। তারা বলেন, উন্নত দেশগুলোর ভোগবিলাসের কারণে গরিব দেশের মানুষেরা মরতে বসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী ও সমুদ্রের ভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। বিশেষ করে দ্বীপ দেশ ও ছোট ছোট দেশের মানুষেরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এ মানুষদের পুনর্বাসন করতে হবে।
সমাবেশ শেষে ক্লাইমেট জাস্টিস নেটওয়ার্কের নেতৃবৃন্দ ইউএনএফসিসিসির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ক্রিশ্চিয়ানা ফিগুয়ারসের কাছে তাদের দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান শেষে বিক্ষোভ মিছিল আবার চলতে শুরু করে। শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে হাজার হাজার মানুষের এ মিছিলটি শহরের নর্থ বিচের মাসিংগা কর্নারে গিয়ে শেষ হয়। জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলোর পরিবেশবাদীরা এ বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। এ সময় মিছিলজুড়েই ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমানে পেছনে এবং দুই পাশে আফ্রিকান পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে সহায়তা করে। তবে দিনব্যাপী চলা এ মিছিল থেকে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আগামী ৭ই ডিসেম্বর জলবায়ু সম্মেলনের শীর্ষ বৈঠক শুরুর পরদিন এ নেটওয়ার্কের আরও একটি মহাসমাবেশ করার কথা রয়েছে।
এদিকে গ্লোবাল কল টু অ্যাকশন এগেইস্ট প্রাভারটি (জিক্যাপ) শুক্রবার রাতে ‘নারীর প্রতি জলবায়ু সুবিচার’ শীর্ষক এক কর্মশালার আয়োজন করে। এতে বাংলাদেশের সংগঠন বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ এ কর্মশালায় তাদের জলবায়ু শুনানির কার্যক্রম ও রায় তুলে ধরেন। সম্প্রতি ঢাকায় তারা এ গণশুনানির আয়োজন করে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালক ড. নীলুফার বানু বলেন, সাইড ইভেন্টে আমরা গণশুনানির কার্যকর তুলে ধরা ছাড়াও শুনানির সিডি বিতরণ করেছি।
সেমিনারে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনযাপন ও অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ প্রটোকল তৈরির দাবি করা হয়। খলীকুজ্জমান বলেন- বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ গৃহচ্যুত হচ্ছে। কানকুন জলবায়ু সম্মেলনে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি নির্দিষ্ট করতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ১৩টি সংগঠন গতকাল আইসিসিতে সেমিনারের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহসান উদ্দিন আহমদ। বক্তৃতা করেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, মিজানুর রহমান বিজয়, ডা. আবদুল মতিন, রেজাউল করিম চৌধুরী, জুন কার্লোস, জানিট রিডম্যান, গোলাম রব্বানী, এলিনা গিরিবিজাসহ অন্যরা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন